গঙ্গারামপুরের সয়রাপুরে ডাকাতদের প্রতিষ্ঠিত কালী মাতাকে আজও নিষ্ঠা-সহকারে পুজো করে আসছেন

0
57

“মন্ডলের বাড়ি থেকে পায় ৩কিলোমিটার দূরে মাকে কাঁধে করে আলো দেখিয়ে মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়” গঙ্গারামপুরের সয়রাপুরে ডাকাতদের প্রতিষ্ঠিত কালী মাতাকে আজও নিষ্ঠা-সহকারে পুজো করে আসছেন জমিদারের বংশধররা,বসে বিরাট আকারে মেলায় থাকে, ভক্তি নিষ্ঠাও
শীতল চক্রবর্তী বালুরঘাট ১৪অক্টোবর দক্ষিণ দিনাজপুর।মায়ের পুজো ও আরাধনা করে ডাকাতি করতে বের হতেন ডাকাত দলের সদস্যরা।দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার গঙ্গারামপুর ব্লকের সয়রাপুর গ্রামে ডাকাতদের প্রতিষ্টিত পুজোকে ঘিরে প্রস্তুতি তুঙ্গে উঠেছে।পূজো নিয়ে রয়েছে বিশেষ নিয়মও,এলাকায় বসে বিরাট আকারে মেলাও।সব মিলিয়ে সয়রাপুরের এই পুজোতে ঘিরে সাজে সাজে রব সমগ্র এলাকা। আজ থেকে প্রায় ৫০২বছর আগের কথা।সেই সময় গঙ্গারামপুর ব্লকের সয়য়াপুরের জমিদার ছিলেন ধ্রুবনাথ দাস। দিনের বেলায় সয়রাপুর এলাকায় হিংস্র জীবজন্তু ঘোরাফেরা করতে বলে জমিদারের পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে।এলাকার চারদিকে ঘন বনজঙ্গলে ঘেরা ছিল।জানা গিয়েছে তখন সন্ধ্যা নামলেই সয়রাপুরের গভীর জঙ্গলে ডাকাত দল আস্তানা গাডতো।দিনের পর দিন ডাকাতদের আনাগোনা বাড়ায় এলাকার মানুষজন ভয়ে শিটিয়ে থাকতেন সেই সময় বলে খবর। মাঝেমধ্যে ডাকাত দল রাতের অন্ধকারে গভীর জঙ্গলে মশাল জ্বালিয়ে পুজো অর্চনা করত বলে খবর।পুজো অর্চনা শেষে ডাকাত দলের সদস্যরা ডাকাতি করার উদ্দেশ্যে বের হতো বলে জানা গিয়েছে।এরপরেই তারা বেরিয়ে যেত ডাকাতি করার উদ্দেশ্যে। ডাকাতদের কার্যসিদ্ধি হলে ফিরে এসে ধুমধাম সহকারে মায়ের পুজো করতে তারা।এমন ঘটনার খবর তৎকালীন জমিদার ধ্রুবনাথ দাসের কাছে ডাকাতেরা পূজো করছে বলে খবর পৌঁছায়। এরপরেই জমিদার ধ্রুবনাথ দাস তার দলবলকে নিয়ে জঙ্গলে হাজির হয়।সেখানে গিয়ে তিনি দেখতে পান পাঁচটি পাথর সহ মায়ের মূর্তি রয়েছে।সঙ্গে সঙ্গে ডাকাতদের পূজা করা পাথরগুলি ও মূর্তি উদ্ধার করে নিয়ে আসেন তিনি।এরপর ডাকাতদের পূজো প্রতিষ্ঠা করেন বাড়িতে।উদ্ধার হওয়া পাথরগুলি গণেশ, সূর্য,বিষ্ণু ,শিব ও দুর্গা রূপে পূজা হয়ে থাকে বহুদিন ধরেই।
জানা গিয়েছে জমিদার ধ্রুবনাথ দাস বেশ কয়েক বছর নিজে হাতে মায়ের পুজোর দায়িত্ব সামলে আসছিলেন।দেশ স্বাধীন হবার পর জমিদারি প্রথা বিলুপ্ত হয়।জমিদার প্রয়াত হবার পর পুজোর দায়িত্ব কাঁধে তুলেছেন জমিদারের আত্মীয় সতীশ চন্দ্র দাস।তিনি প্রয়াত হবার পর পুজোর দায়িত্ব পান তার ভাই বঙ্কিম চন্দ্র দাস। বঙ্কিম বাবু প্রয়াত হবার পরে সেই পূজো বারোয়ারী পুজোতে রূপ প্রায়। বারোয়ারি পূজোর রূপ পেলেও পুজোর দায়িত্ব থাকে জমিদারের বংশধরদের হাতেই। যা বর্তমানে জমিদারদের বংশধর সুখেন্দু দাস কিছুদিন পূজোর দায়িত্বভার পেয়েছিলেন। তিনি এখন প্রয়াত হয়েছেন। বর্তমানে পুজোর দায়িত্ব সামনে আসছেন তাদের এক বংশধর প্রশান্ত দাস। প্রশান্ত দাসের পরিবার সূত্রে জানা গিয়েছে,সয়রাপুরে জমিদারদের পুজোয় বলি প্রথা রয়েছে। মায়ের চক্ষুদানের সময় পশু বলি দেওয়া হয়।সেই নিয়ম বহুদিন ধরেই চলে আসছে। পুজোতে মন্ডল প্রথা রয়েছে। নিয়ম অনুযায়ী মন্ডলের বাড়িতে প্রতিমা তৈরি করা হয়।যেহেতু এক সময় ডাকাতদের পূজো ছিল তাই মন্ডলের বাড়ি থেকে পায় ৩কিলোমিটার দূরে মাকে কাঁধে করে আলো দেখিয়ে মন্দিরে নিয়ে যাওয়া হয়।এই পুজোতে বাইরে থেকে কোন চাঁদা তোলা হয় না,যা জমিদারের দেওয়া মায়ের নামে পুকুর ও জমি রয়েছে ,সেই জমি ও পুকুরে চাষাবাদ ও মাছ চাষ করে যা আর্থিক অর্থ উপার্জন হয় সেটা দিয়েই পুজো হয়ে থাকে বছরের পর বছর।পুজো ঘিরে বসে বিরাট আকারে মেলাও।দূর দূরান্ত থেকে ভক্তরা আসেন মায়ের এই পুজো দেখতে। পুজোর অন্যতম কর্মকর্তা বাদল চন্দ্র সরকার,নাথুরাম সরকারদের কথায়,শুনেছি একসময় জঙ্গলে ডাকাতরা পূজো করত।সেটা জমিদার জানতে পেরে পাথরের মূর্তি উদ্ধার করে পুজো করেন। প্রতিবছর আমরা এই পুজোয় অংশ নেন।পুজোর জন্য আত্মীয়-স্বজনেরা বাইরে থেকে এই দিনটাতে এখানে আসেন। জমিদারদের বংশধর প্রশান্ত দাস জানান,একসময় সয়রাপুর এলাকায় গভীর জঙ্গলে ভর্তি ছিল।সেই সময় মশার জ্বালিয়ে কে বা কাহারা পূজো করতেন মাকে,পুজো শেষে তারা আবার সেখান থেকে চলেও যেতেন। জমিদার একদিন বিষয়টি জানতে পেরে জঙ্গল থেকে পাথরের মূর্তিগুলি উদ্ধার করে নিয়ে আসেন এবং মন্দির তৈরি করে পুজো শুরু করেন। প্রশান্ত বাবু আরো জানান, বংশ পরম্পরায় আমরা এই পুজো করে আসি প্রতিবছর নিয়ম নিষ্ঠা সহকারে ।পুজো করা হয় এবারও তা করা হচ্ছে। সয়রাপুর এলাকার গ্রামবাসী তারাপদ বর্মন,রিনা বর্মনেরা জানান, আমরা মাকে কাঁধে করে নিয়ে প্রায় ছয় কিলোমিটার পথ হেঁটে জমিদারের বাড়িতে যায়। সেখানে জমিদারদের বংশধরেরা মাকে পুজো দেন।এরপর কাঁধে করে মাকে সয়রাপুর মন্দিরে নিয়ে আসা হয়।প্রতিবছরের মতো এখন দীপান্বিতা অমাবস্যার দিনে গঙ্গারামপুরের এই সার্বজনীন কালী মাতার পূজা হয়।সেখানে অবশ্য দাস পরিবারের অন্যতম বংশধর কুসুম দাস কালী মাতার পুজোর দিন উপস্থিত থেকে মাকে পুজো দিয়ে মঙ্গল প্রার্থনা করেন।সেই সঙ্গে সকলের সঙ্গে মিলিতভাবে মায়ের এই পুজো পালন করে থাকেন তারা। সবমিলিয়ে ভক্তি ও নিষ্ঠা সহকারে এবারও পূজা হবে সয়রাপুরে ডাকাতদের হাতে পুজো হওয়া কালীমাতার। পুজোকে ঘিরে বসে বিরাট আকারে মেলাও।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here