গঙ্গারামপুরের উদয় ভট্টাচার্য্যপাড়া দুর্গামণ্ডপের শতাব্দীপ্রাচীন পূজা

0
42

গঙ্গারামপুরের উদয় ভট্টাচার্য্যপাড়া দুর্গামণ্ডপের শতাব্দীপ্রাচীন পূজা ,যা এবছর হচ্ছে নিয়ম মেনেই
শীতল চক্রবর্তী, বালুরঘাট, ২৮ অগস্ট।অধুনা পাকিস্তানের অংশ রাজশাহীর তারাজু গ্রামের প্রভাবশালী জমিদার পূর্ণচন্দ্র শর্মারায়–এর রাজত্বকালে ১৭৪২ সালে বর্গীর ভয়ঙ্কর আক্রমণ থেকে বাঁচতে বর্ধমান জেলার সিঙ্গি গ্রাম থেকে দক্ষিণ দিনাজপুরের কুমারগঞ্জ ব্লকের বরম গ্রামে আশ্রয় নেন পণ্ডিত রঘুনাথ মুখোপাধ্যায়।তৎকালীন সময়ে জমিদার পূর্ণচন্দ্র শর্মারায়ের সভায় দেশ-বিদেশের তর্কশাস্ত্রবিদরা এসে বিতর্কে অংশ নিতেন।কাশীর একজন খ্যাতনামা পণ্ডিতের সঙ্গে তর্কযুদ্ধে জয়ী হয়ে রঘুনাথ মুখোপাধ্যায় পান “তর্কালঙ্কার” উপাধি বলে জানা গিয়েছে।পরবর্তীতে জমিদার তাঁকে কুলপুরোহিত হিসেবে নিয়োগ করেন এবং তারাজু গ্রামে বসবাসের জন্য জমি দান করেন।এরপর পণ্ডিত রঘুনাথ মুখোপাধ্যায় গ্রামটির নাম পরিবর্তন করে রাখেন “উদয়” এবং ১৭৪৩ সালে নিজের গৃহে দুর্গাপূজা শুরু করেন সেই সময় থেকেই।সেই পূজা আজও বংশপরম্পরায় অব্যাহত রয়েছে।বর্তমানে এই পুজো পাঁচ শরিক পরিবারের পালাবদলের মাধ্যমে পরিচালিত হয়।পূজার ঐতিহ্য ও বিশেষত্ব
মেনে দেশভাগের পর দিনাজপুর জেলা ভাগ হলেও এই পূজার আচার-অনুষ্ঠান ও জৌলুসের কোনো পরিবর্তন ঘটেনি আজও। মুখোপাধ্যায় পরিবার আজও আগের মতো একই নিয়মে পূজোর আয়োজন করে আসছে।দেবীর সঙ্গে পূজিত হয় মনসার ঘট।দেবী দুর্গা পূজিত হন তান্ত্রিক মতে।পাঁঠা বলি দেওয়া হয় সপ্তমী, অষ্টমী, নবমী ও একাদশীতে। একাদশীর দিন মনসার ঘটের বিসর্জন দেওয়া হয়।
দুর্গার ভোগে থাকে বিশেষভাবে পাঁঠার মেটে, যা এই পূজার এক অন্যতম বৈশিষ্ট্য।সপ্তমী,অষ্টমী ও নবমীতে অন্নভোগের সঙ্গে বিভিন্ন রকমের ভাজা পরিবেশন করা হয়।ষষ্ঠী থেকে দশমী পর্যন্ত চলে চণ্ডীমঙ্গল গান,এবং প্রতিদিন সন্ধ্যায় বসে মনসার গানের আসর।
শতশত বছর ধরে এই রীতি একইভাবে অক্ষুণ্ণ রয়েছে।
স্বপ্নাদেশ পেয়ে এই পরিবারে কোজাগরী লক্ষ্মী পূর্ণিমাতেই শুরু হয় কালীপূজা।এখানে আলাদা করে লক্ষ্মীপূজা হয় না। মা কালীকেই লক্ষ্মীরূপে পূজা করা হয়।
দেবী পূজিত হন পঞ্চমুণ্ডির আসনে সম্পূর্ণ তান্ত্রিক নিয়মে।পশুবলির প্রচলন রয়েছে।ভোগে থাকে জমির ধানের চালের অন্ন, মুরকি, নাড়ু, মিষ্টি, ফলমূল, মাছ ও মাংস।বলির মাংস রান্না করে দেবীকে উৎসর্গ করার রীতিও রয়েছে।এছাড়াও, মুখোপাধ্যায় পরিবারের অপর শরিকরা এখনও বর্ধমান জেলার সিঙ্গি গ্রামে একই নিয়মে সিদ্ধিকালী পুজো আয়োজন করেন।
শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যের সাক্ষী হিসেবে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার গঙ্গারামপুর ব্লকের উদয় ভট্টাচার্য্যপাড়া দুর্গামণ্ডপ কেবল একটি পূজামণ্ডপ নয়,এটি দক্ষিণ দিনাজপুরের আঞ্চলিক ইতিহাস,তান্ত্রিক সাধনা,পারিবারিক ঐতিহ্য ও লোকসংস্কৃতির জীবন্ত প্রতিচ্ছবি।বংশানুক্রমে প্রজন্মের পর প্রজন্ম ধরে ।আজও সেই একই শুদ্ধ আচার-অনুষ্ঠান ও ভক্তিভরে পূজো চলে আসছে।
মুখার্জি পরিবারের বংশধর গোবিন্দ মুখার্জি জানান,”পুরনো রীতি মেনেই পুজো হয়ে থাকে ১৭৪৩ সাল থেকে নিজ বাড়িতেও দুর্গাপূজা শুরু করেন যা আজও বংশানুক্রমিক ভাবে ৫ শরিকদের পালাবদল-এর মাধ্যমে হয়ে আসছে। এবারের ২৮৩ বছর তাদের পূজোর পদার্পণ করবে।” এলাকার স্থানীয় বাসিন্দা শ্যামল মুখার্জি জানান,” ভক্তি নিষ্ঠার জন্যই প্রতিবছরেই পুজোতে ছুটে যাব সেখানে। নিয়ম নিষ্ঠা কোন ত্রুটি থাকে না দুর্গাপুজোতে।মায়ের কাছে আশীর্বাদ প্রার্থনা করতে যাই আমরা।” উদয় গ্রাম পঞ্চায়েতের প্রধান অসিত বরন কুন্ডু বলেন,”এই পূজোর বহু ইতিহাস জড়িয়ে রয়েছে।বাবার কাছ থেকেই পুজোর গল্প শুনেছি,একবার হলেও পুজোর দিন ছুটে যায় সেখানে ভক্তি ও নিষ্ঠার জন্য।” ভক্তি ও নিষ্ঠার মধ্য দিয়ে মুখার্জী বাড়ির পুজো এবারও নিয়ম নিষ্ঠার সঙ্গে হবে বলে মনে করছে অনেকেই।

LEAVE A REPLY

Please enter your comment!
Please enter your name here