বালুরঘাটে সরকারি হাসপাতালে জাল ইঞ্জেকশনের ছোবল! প্রসূতির মৃত্যুতে তীব্র চাঞ্চল্য, মৃত্যুমুখে আরও আট
বালুরঘাট, ১৯ জুলাই ——- সরকারী হাসপাতালে জাল ওষুধ ব্যবহারের অভিযোগ, মৃত্যু এক প্রসূতির। জীবন-মৃত্যুর মুখে দাঁড়িয়ে আরও আট মহিলা। ঘটনাকে ঘিরে তীব্র চাঞ্চল্য দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট সুপার স্পেশালিটি হাসপাতালে। চিকিৎসা গাফিলতি, নাকি চক্রবদ্ধ জাল ওষুধ কারবারের ফাঁদ—এমন প্রশ্নেই এখন উত্তাল গোটা হাসপাতাল চত্বর।
তপন থানার গুড়াইল পঞ্চায়েতের মকদমপুর গ্রামের সুষমিতা রায় বর্মন। বয়স মাত্র ২১। বৃহস্পতিবারই প্রসব যন্ত্রণায় ভর্তি হন বালুরঘাট জেলা হাসপাতালে। সুস্থভাবে কন্যাসন্তানের জন্মও দেন। তখনও শরীরে কোনও অস্বাভাবিকতা ছিল না। হাসপাতালের সাধারণ বেডেই ছিলেন তিনি। কিন্তু শুক্রবার ভোরে হাসপাতালের নার্স একটি ইঞ্জেকশন প্রয়োগ করতেই সব ওলটপালট। আচমকা শ্বাসকষ্ট, প্রবল শারীরিক দুর্বলতা। চিকিৎসকদের হাতে আর সময় ছিল না। তড়িঘড়ি সিসিইউ-তে নিয়ে গেলেও শেষরক্ষা হয়নি। অকালে ঝরে যায় এক তরতাজা প্রাণ। মাতৃহারা সদ্যোজাত শিশুর কান্নায় ভেঙে পড়ে গোটা পরিবার।
কিন্তু এখানেই শেষ নয়। এরপর রাতের দিকে একের পর এক প্রসূতির শরীরে দেখা দেয় একই উপসর্গ। শ্বাসকষ্ট, অজ্ঞান হয়ে পড়া, জ্বর, শারীরিক অস্বস্তি। আতঙ্ক ছড়ায় হাসপাতাল জুড়ে। তড়িঘড়ি আটজন প্রসূতিকে স্থানান্তর করা হয় সিসিইউতে। রাতভর নজরদারিতে থাকেন জেলার মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক সুদীপ দাস। তিন সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন হয়েছে। সংশ্লিষ্ট ব্যাচের ইঞ্জেকশন ব্যবহারেও জারি হয়েছে নিষেধাজ্ঞা। যদিও মৃত প্রসূতির মৃত্যুর কারণ নিয়ে এখনও নিশ্চুপ স্বাস্থ্য দপ্তর।
অন্যদিকে এই ঘটনাকে কেন্দ্র করে শুরু হয়েছে তীব্র রাজনৈতিক চাপানউতোর। চলে হাসপাতাল সুপারের অফিস ঘেরাও করে বিক্ষোভও। যাকে ঘিরে উত্তপ্ত হয়ে ওঠে বালুরঘাট সুপার স্পেশালিটি হাসপাতাল। বিক্ষোভকারীদের অভিযোগ, রাজ্যজুড়ে এই জাল ওষুধ চক্র ছড়িয়ে পড়েছে। সরকারী হাসপাতালে জাল ওষুধ ব্যবহারের বিষক্রিয়ায় এক মহিলার মৃত্যু হয়েছে এবং বাকি আট মহিলা আশঙ্কাজনক অবস্থায় রয়েছে। তাদের আরো দাবি, এই ঘটনা নিয়ে কেন্দ্রীয় স্তরের তদন্ত চাই।
বিজেপির জেলা সাধারণ সম্পাদক বাপী সরকার অভিযোগ করে বলেন, ‘‘জাল ওষুধে ছেয়ে গিয়েছে রাজ্যের হাসপাতাল। সরকারি হাসপাতালের নিরাপত্তা, নজরদারি নেই। রাজ্য সরকারের গাফিলতির ফলেই এই মৃত্যু। কেন্দ্রীয় স্তরের তদন্ত না হলে লাগাতার আন্দোলন জারী থাকবে তাদের।
সিপিএম নেতা অনিমেষ চক্রবর্তী বলেন, বিভিন্ন ওষুধ কোম্পানিগুলোর কাছ থেকে কোটি কোটি টাকা তুলেছে তৃণমূল ও বিজেপি। আর তার জেরেই এমন ভেজাল ওষুধ সরবরাহ চলছে সরকারী হাসপাতালে। ঘটনা নিয়ে উচ্চ পর্যায়ের তদন্ত চান তারা।
শ্রেয়সী লাহা ও বিশ্বজিৎ পাল নামে দুই রোগীর আত্মীয় বলেন, ইঞ্জেকশন ব্যবহারের পর থেকেই শ্বাসকষ্ট শুরু হয় প্রত্যেকের। তড়িঘড়ি হাসপাতাল কতৃপক্ষ তাদের সিসিইউতে স্থানান্তর করেছে। ভুল বা জাল ওষুধ প্রয়োগের ফলেই এমনটা হয়েছে বলে তাদের মনে হচ্ছে। ঘটনা নিয়ে তারা উপযুক্ত তদন্ত চান।
হাসপাতালে চিকিৎসকদের একাংশও এই ঘটনা নিয়ে হতবাক। একই ব্যাচের ওষুধ অন্যান্য জায়গায় ব্যবহৃত হলেও, কেন শুধু বালুরঘাটে এই বিপর্যয়? প্রাথমিকভাবে ইনফেকশন বললেও, মুখ্য স্বাস্থ্য আধিকারিক জানিয়েছেন, তদন্ত শেষ না হওয়া পর্যন্ত নিশ্চিত হওয়া যাচ্ছে না। তবে রাজ্যের স্বাস্থ্য দপ্তরকে প্রতি মুহূর্তে আপডেট পাঠানো হচ্ছে। আপাতত বালুরঘাট হাসপাতালে ওই ইঞ্জেকশন ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা জারি করা হয়েছে। তিনজনের একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। পরিস্থিতি কিছুটা স্থিতিশীল রয়েছে।
এখন একটাই প্রশ্ন— সরকারি হাসপাতালের শিরায় কীভাবে ঢুকে পড়ল এই ‘মৃত্যু-ইঞ্জেকশন’? দায় কার? জাল ওষুধের চক্রই কি এই মৃত্যুর নেপথ্যে? উত্তর চাইছে গোটা দক্ষিণ দিনাজপুর জেলা। এদিকে, মাকে হারিয়ে অসহায় এক শিশুর আর্তনাদ যেন গোটা স্বাস্থ্য ব্যবস্থার গালেই চড় মেরেছে! জেলা জুড়ে এখন একটাই দাবি, দোষীদের শাস্তি চাই।