পিন্টু কুন্ডু, বালুরঘাট, ৯ অক্টোবর ——– পুর্ব পাকিস্তানে পূজিত দুর্গা আজও সম্প্রীতির বার্তা বহন করছে ভারতে। প্রথা মেনে বংশ পরম্পরাগত ভাবে মন্ডল পরিবারের পুজো প্রায় সাড়ে তিনশো বছরের ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। বালুরঘাটের গোপালবাটি গ্রাম পঞ্চায়েতের অন্তর্গত ইন্দ্রা গ্রামের এই দুর্গাপুজা আজো পাকিস্তানের সেই ইতিহাসকেই যেন স্মরণ করিয়ে দেয়। ভারতের স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে পুর্ব পাকিস্তানের দুর্গা মন্দিরের মাটি আচলে বেধে এনে গড়া মন্দিরের দুর্গা উৎসব বর্তমানে বাংলার সম্প্রীতির যেন এক খন্ডচিত্র হয়ে দাড়িয়েছে। এখানেই মসজিদের আজানের সুর এবং দুর্গা মন্দিরের ঢাক ও শাঁকের আওয়াজ মিলিত হয় বাতাসে। ৬৮ বছর ধরে মসজিদের নামাজ এবং দুর্গামন্দিরের অস্টমীর অঞ্জলি যেন বাংলার সম্প্রীতির এক ঐতিহ্য বহন করে আসছে দক্ষিণ দিনাজপুর জেলার বালুরঘাট ব্লকের এই ইন্দ্রা গ্রাম।

জানা যায় এই মন্ডল বাড়ির দুর্গোৎসবের শুরুটা প্রায় সাড়ে তিনশো বছর পূর্বে মন্ডল বংশের পূর্ব পুরুষ প্রাণধন মন্ডলের হাত ধরেই হয়েছিল। এরপর বংশানুক্রমে ঈশ্বরচন্দ্র মন্ডল এবং পরবর্তী সময়ে পুর্ব পাকিস্তানের পলাশবাড়ি গ্রামে বিধুভূষণ মন্ডল এই পূজো চালিয়ে আসছিলেন। ১৯৫২ সালে পুর্ব পাকিস্তানে থাকা সম্পত্তি বিনিময় করে বিধুভূষন মন্ডল চলে আসেন ভারতে। কুলদেবী দুর্গাকে পাকিস্তানে ছেড়ে না এসে বিধুভূষনের স্ত্রী পুর্ব পাকিস্তানের দুর্গা মন্দিরের মাটি আঁচলে বেধে এনে বালুরঘাটের পতিরাম থানার অন্তর্গত গোপালবাটি গ্রাম পঞ্চায়েতের ইন্দ্রা গ্রামে নিজের বাড়ির পাশেই গড়েন দুর্গা মন্দির। সেই থেকেই ইন্দ্রা গ্রামে পূজিত হয়ে আসছে মন্ডল বাড়ির দেবী দুর্গা। তবে অনান্য দুর্গাপূজা থেকে ইন্দ্রা গ্রামের মন্ডল বাড়ির পুজার পদ্ধতিতে রয়েছে বেশকিছু পরিবর্তন। এখানে সপ্তমীর দিন থেকে শুরু হওয়া যজ্ঞের আগুন নেভে নবমীতে। ৩ জন পুরোহিতের পৌরহিত্যে ১০৮টি বেলপাতা আহুতি দেওয়া যজ্ঞে। শুধু তাই নয় মন্ডল বাড়ির দুর্গাকে অন্নভোগ নিবেদন করার রীতি না থাকলেও বর্তমানে সপ্তমীতে সাত রকমের রান্না করা ভোগ, অস্টমীতে আট রকম এবং নবমীতে নয় রকমের ভোগ নিবেদন করা হয় দেবী দুর্গাকে। অতীতের নিয়ম মেনে সন্ধিপুজোর শুরু হয় বন্দুকের গুলি ফাটিয়ে।
মন্ডল বাড়ির সদস্য শুভম মন্ডল জানান তাদের বাড়ির দুর্গাপূজায় অতীতের রীতি মেনে সন্ধি পূজো শুরু হয় এখানে বন্দুকের গুলি দেগে।

বিভিন্ন সম্প্রদায় ভুক্ত প্রায় দুই শতাধিক পরিবারের বাস গোপালবাটি গ্রাম পঞ্চায়েতের এই ইন্দ্রা গ্রামে। দুর্গামন্দিরের গা লাগোয়া রয়েছে ইন্দ্রা গ্রামের মসজিদও। যেখানে দিনে প্রায় ৫ বার পড়া হয় নামাজ। ষষ্ঠী থেকে দশমী অবধি ইন্দ্রা গ্রামের মন্ডল বাড়ির দুর্গা মন্দির চাতাল থেকে যখন ভেসে আসে মঙ্গলচন্ডীর গানের সুর, সেই সময় কার্যত দুর্গা মন্দিরের গা লাগোয়া ইন্দ্রা গ্রামের মসজিদ থেকেও ভেসে আসে আজানের সুর। যা বাতাসে মিলেমিশে এক সম্প্রীতির বাতাবরণে দেবী দশভূজা যেন হয়ে উঠেন দেবী মিলনময়ী।

মন্ডল বাড়ির সপ্তম পুরুষ পঞ্চানন মন্ডল জানান তাদের পরিবারের এই দুর্গোৎসবের আনন্দের শরিক হন এলাকার সব সম্প্রদায়ের মানুষরা। সেই সঙ্গে তিনি জানান দশমীর দিন মন্দির সংলগ্ন পুকুরেই নিয়ম মেনেই হয় দেবীর বিসর্জন।