ত্রিপলের নিচে তিন যুগের কান্না! তপনের এনায়েতপুরে আদিবাসী বৃদ্ধার একাকীত্বে কাঁদছে মানবতা
শীতল চক্রবর্তী, বালুরঘাট, ৪ জুন ——–
রাত নামলেই ঘুমিয়ে পড়ে গোটা গ্রাম। কিন্তু ছেঁড়া ত্রিপলের নিচে তখনও জেগে থাকেন মুখী সরেন। অপেক্ষা করেন আর এক ভোরের। যে ভোরও বয়ে আনে শুধুই ক্ষুধা, অনিশ্চয়তা আর অসম্মানের দীর্ঘশ্বাস। দক্ষিণ দিনাজপুরের তপন ব্লকের ৫নম্বর দ্বীপখন্ডা গ্রাম পঞ্চায়েতের এনায়েতপুর গ্রামে আজও তিন যুগ ধরে মানবিকতার মুখোমুখি দাঁড়িয়ে একা লড়াই চালিয়ে যাচ্ছেন বছর ষাটের এক আদিবাসী বৃদ্ধা।
স্বামী নেই। সন্তান নেই। পরিজন তো দূর অস্ত। ছোট্ট একটুকরো জমিতে জোগাড় করা ছেঁড়া ত্রিপলের নিচেই তার বাস। নেই চুলা, নেই ছাই, নেই সঞ্চয়। যেদিন পাড়ায় ঘুরে খাবার জোটে, সেদিন খেতে পারেন। না হলে? দিনটা কেটে যায় না খেয়ে। কাঁপা গলায় বলেন, “পেটের ভাত বুঝি, কাগজপত্রের রাজনীতি বুঝি না বাপু। মাথার উপর একখানি ছাদ চাই, যাতে ঝড়-বৃষ্টিতে ভিজে না মরি।”
শৌচকর্ম সারতে যেতে হয় মাঠে, জল আনতে পাশের সরকারি টিউবওয়েলে। সেখানেও এখন জল আসে না। মুখী সরেনের জীবনে জল যেমন নেই, তেমনই নেই জীবনের প্রতি কোনও স্থিরতা। শুধু কষ্টের স্রোত বইছে অবিরাম।
এলাকার প্রত্যক্ষদর্শী অশোক প্রামাণিক বলেন, “ওই দৃশ্য দেখে চোখে জল আসে। তিন যুগ ধরে একা একজন মানুষ এভাবে বেঁচে আছেন, এটা আমাদের সমাজের জন্য লজ্জার।”
পঞ্চায়েত প্রধান ইমতিয়াজ সরকার জানিয়েছেন, “সরকারি নথি না থাকায় কিছুটা সমস্যা হচ্ছে, তবে মানবিকতার দিক থেকে সাহায্যের চেষ্টা চলছে।”
তপন ব্লকের বিডিও তীর্থঙ্কর ঘোষ বলেন, “বিষয়টি গুরুত্ব সহকারে দেখা হচ্ছে।”
কিন্তু প্রশ্নটা জ্বলে উঠছে আগুনের মতো—ত্রিপলের নিচে যিনি তিন দশক ধরে বেঁচে আছেন, তাঁর কাছে কি রাষ্ট্র শুধুই কাগজের গল্প? কোথায় সাংসদ? কোথায় বিধায়ক? কোথায় আদিবাসী নেতারা, যাঁরা মিছিল করেন, শ্লোগান তোলেন, মঞ্চে দাঁড়িয়ে আবেগে ভাসেন? মুখী সরেনের নিঃশব্দ আহ্বান কি তাঁদের কানে পৌঁছয় না?
আকাশের দিকে চেয়ে আজ মুখী সরেন বলেন না কিছু, শুধু পাটকাঠির কঞ্চির ফাঁক দিয়ে বৃষ্টি পড়ে তাঁর গায়ে। তিনি দাঁতে দাঁত চেপে থাকেন। কেননা তিনি জানেন, ত্রিপলের নিচে কান্না শোনার সময় কারও নেই।
Home উত্তর বাংলা দক্ষিণ দিনাজপুর ত্রিপলের নিচে তিন যুগের কান্না! তপনের এনায়েতপুরে আদিবাসী বৃদ্ধার একাকীত্বে কাঁদছে মানবতা