গণধর্ষণ, নৃশংস খুন—তারপর আগুনে পুড়িয়ে প্রমাণ লোপাট! পাঁচ বছর পর কুমারগঞ্জ কাণ্ডে তিন অভিযুক্তের যাবজ্জীবন সাজা দিল আদালত
বালুরঘাট, ৬ ডিসেম্বর —- কুমারগঞ্জের নাবালিকা স্কুলছাত্রীকে তুলে নিয়ে গণধর্ষণ, খুন এবং আগুনে পুড়িয়ে প্রমাণ লোপাট—দক্ষিণ দিনাজপুরের সবচেয়ে নৃশংস ঘটনার পাঁচ বছর পর অবশেষে রায় শোনাল বালুরঘাট জেলা আদালত। শনিবার ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টের বিচারক সন্তোষ কুমার পাঠক অভিযুক্ত তিন যুবক—মহাবুর মিঞা, গৌতম বর্মন ও পঙ্কজ বর্মন—কে ভারতীয় দণ্ডবিধির ৩০২, ২০১ ও ৩৪ ধারায় যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করেন।
রায়ের সঙ্গে সঙ্গেই আদালত চত্বর জুড়ে নেমে আসে নীরব চাপা উত্তেজনা—বিচার হলেও পরিবার–পরিজনের চোখে যেন এখনো অদম্য ক্ষোভ ও না-পাওয়া ন্যায়ের হাহাকার।
সরকারি আইনজীবী ঋতব্রত চক্রবর্তী জানান, ২০২০ সালের ৫ জানুয়ারি বিকেলে গঙ্গারামপুরের পঞ্চগ্রামের ওই নাবালিকা স্কুলছাত্রী চাদর কিনতে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আর ফেরেনি। রাতভর খোঁজাখুজি করেও তাকে না পেয়ে পরিবার পরের দিন কুমারগঞ্জ থানায় অভিযোগ দায়ের করে। তদন্তে সামনে আসে ভয়ঙ্কর চিত্র—দীর্ঘদিন ধরেই মহাবুর মেয়েটিকে উত্যক্ত করত। বিয়ের প্রস্তাব দিয়ে চাপ, বাড়িতে ঢুকে মারধর—সব মিলিয়ে ভয়ঙ্কর হয়রানির ফাঁদে জড়িয়ে পড়েছিল অসহায় নাবালিকাটি। মা–দাদা চটকল শ্রমিক হওয়ায় বেশিরভাগ সময় বাড়িতে একাই থাকত সে—আর সেই সুযোগেই নৃশংস পরিকল্পনা কষেছিল মহাবুর ও তার দুই সঙ্গী।
অভিযোগ অনুযায়ী, সেদিন মহাবুর ফুঁসলিয়ে মেয়েটিকে মোটরবাইকে তোলে এবং গৌতম–পঙ্কজকে সঙ্গে নিয়ে কুমারগঞ্জের বেলখোর এলাকার কালভোটের পাশে নির্জন স্থানে নিয়ে যায়। সেখানে তাকে প্রথমে গণধর্ষণ করা হয়, তার পর খুন। প্রমাণ লোপাটে অভিযুক্তরা দেহে পেট্রোল ঢেলে আগুন লাগিয়ে দেয়।
পুলিশ টানা তদন্ত চালিয়ে ঘটনার ৪৮ ঘণ্টার মধ্যেই তিনজনকেই গ্রেফতার করে। প্রথমে ধরা পড়ে গৌতম—তার জবানবন্দিতেই সামনে আসে ঘটনার নৃশংস সত্যতা। পরপর ধরা পড়ে মহাবুর ও পঙ্কজ। তিনজনের বিরুদ্ধেই গণধর্ষণ, খুন ও প্রমাণ লোপাটের মামলা রুজু হয়।
তারপর শুরু হয় দীর্ঘ আইনি লড়াই। পাঁচ বছর ধরে বালুরঘাট ফাস্ট ট্র্যাক কোর্টে চলা শুনানির পর শুক্রবার তিন অভিযুক্তকে দোষী সাব্যস্ত করা হয়। শনিবার বিচারক রায় ঘোষণা করেন—৩০২ ধারায় যাবজ্জীবন সশ্রম কারাদণ্ড, সঙ্গে ১০ হাজার টাকা জরিমানা (অনাদায়ে আরও ৩ বছরের জেল) ৩৪ ধারায় ৭ বছর সশ্রম কারাদণ্ড, ৫ হাজার টাকা জরিমানা (অনাদায়ে দু’মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড)২০১ ধারার অপরাধেও দণ্ডিত তিন অভিযুক্ত
তবে আদালতের এই রায়েও শান্তি পেল না নিহত স্কুলছাত্রীর পরিবার। তাঁদের কথায়,
“মেয়েকে যেভাবে শেষ করেছে… তাদের ফাঁসি ছাড়া ন্যায় পূর্ণ হল না।”
২০২০ সালের সেই রাতের আতঙ্ক—যেদিন আগুনে ঝলসানো দেহ উদ্ধার হয়েছিল বেলখোর মাঠের ধারে—আজও যেন তাড়া করে জেলার মানুষকে। পাঁচ বছর পর বিচার শেষে কিছুটা স্বস্তি মিললেও রক্তহিম করা সেই স্মৃতি আবারও সামনে এনে দিল শনিবারের রায়। ন্যায় পাওয়া গেল—কিন্তু
জেলার মানুষের মনেই থেকে গেল সেই অনন্ত প্রশ্ন।

















